Sun. Sep 8th, 2024

পর্যটন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কচ্ছপগতি

পর্যটন অর্থনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলো বড় দৃষ্টান্ত দেখালেও অপার সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। বিগত সরকার দেশের পর্যটন খাতের পরিকল্পিত বিকাশে যে ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তা বাস্তবায়নে কোনো গতি নেই। এমনকি মহাপরিকল্পনার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে যেসব বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেগুলোও থমকে গেছে। এতে পর্যটন অর্থনীতির বড় স্বপ্ন শুরুতেই যেমন ধূসর হয়ে পড়ছে, তেমনি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। গত এক-দেড় দশক ধরে দেশের সম্প্রসারিত অর্থনীতিতে পর্যটনের প্রত্যাশিত হিস্যা মিলছে না।

পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, বছর চারেক আগে পর্যটন খাতে মহাপরিকল্পনার যে রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাস্তবায়নে দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। উলটো সেই রূপরেখার অংশ হিসেবে নেওয়া বড় প্রকল্পগুলো আটকে গেছে কম বরাদ্দ, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা, উদ্যোক্তাদের অনাগ্রহ আর বিগত সরকারের তদারকির ঢিলেমিতে। পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, অপার সম্ভাবনা থাকলেও বিশ্বে পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে তলানিতে। মুন্ডি ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, পর্যটনশিল্পে বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪১তম, আর এশিয়ার ৪৬টি দেশের মধ্যে ৪২তম। তাই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে যত দেরি হবে, পর্যটন খাতে ততই বাড়বে অব্যবস্থাপনা।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের পর্যটন খাতে ট্যুরিজম মাস্টারপ্লান বা পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে বিদেশি পরামর্শক সংস্থা আইপিই গ্লোবাল। ২০১৯ সালে সংস্থাটির সঙ্গে চুক্তি করা হলেও আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। ২৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে মাস্টারপ্ল্যানের কাজটি শেষ করার কথা ছিল একই বছরের ৩১ জুন। তবে করোনার কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় সময় বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।

তথ্যমতে, সে সময় মাস্টারপ্ল্যান তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা অভিযোগ তুললেও তা আমলে নেয়নি বিগত সরকার। শেষ অবধি গেল বছরের শেষের দিকে দেশি-বিদেশি পরামর্শকদের পরামর্শে তৈরি ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি)। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতে বিগত সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাতে নীতিগত অনুমোদন দেন। ২০৪১ সাল অবধি পর্যটন খাতের এই রোড ম্যাপ বাস্তবায়নে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ ও দেশীয় কর্মসংস্থান তৈরিকে লক্ষ্য ধরা হয়েছে।

বিটিবির তথ্যমতে, ২০২৪ থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরের মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে বিদেশি পর্যটক নিয়ে আসার লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫০ লাখ ৫০ হাজার। কর্মসংস্থানের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের। এর মধ্যে ২০৩০ সাল অবধি ধরা হয়েছে ৭২ লাখ ৮৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। তাছাড়া মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে পাঁচটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এতে চিহ্নিত করা হয়েছে ১ হাজার ৪৯৮টি পর্যটন সম্পদ। যার মধ্যে বিভাগভিত্তিক আঞ্চলিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্যমতে, দেশের জনপ্রিয় কিছু পর্যটন এলাকার উন্নয়নে যেসব বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে সেগুলো বছরের পর বছর ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। বিগত সরকারের দেওয়া বরাদ্দ ব্যয় করতে না পারায় প্রতি বছরই বড় অংশ ফেরত এসেছে। ২০১৮ সালে ৪৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন পেলেও গত অর্ধযুগে ১০ শতাংশ কাজও হয়নি। সদ্য বিদায়ি অর্থবছরে চার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও ১০ লাখ টাকা রেখে বাকি অর্থ ফেরত এসেছে।

এদিকে বিগত ২০১৭ সালে ৭১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের পারকিতে পর্যটনসুবিধা বাড়াতে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হলেও ৫০ শতাংশ কাজও শেষ হয়নি। গেল অর্থবছরে প্রকল্পটিতে বাড়তি ১৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে ২০১৮ সালে ৩৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে পঞ্চগড়ে পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হলেও এখনো কোনো কাজ হয়নি। গেল অর্থবছরে যে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা ব্যয় করতে না পারায় ফেরত এসেছে।

বরিশালের দুর্গাসাগর এলাকায় পর্যটনসুবিধা সৃষ্টি করতে ২০১৮ সালে ১৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নেওয়া হয়। গেল অর্থবছরে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে আরও ৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে মহানন্দায় শেখ হাসিনা সেতুসংলগ্ন এলাকায় পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণে ২০১৮ সালে ৪৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটিতে গেল অর্ধযুগে ১০ শতাংশ কাজও হয়নি। গেল অর্থবছরে আরও ৪ কোটি টাকা দেওয়া হলেও তা ফেরত এসেছে।

এছাড়া ২০২১ সালে ২২৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে দেশের ভেতরে পর্যটন আকর্ষণীয় এলাকায় ট্যুর পরিচালনায় টুরিস্ট কোচ সংগ্রহ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। তবে সেই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়েও কোচ কিনতে পারেনি পর্যটন করপোরেশন। গেল অর্থবছরে কোচ কেনার জন্য আরও ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কেনা হয়নি কোনো কোচ।

শুধু যে প্রকল্প বাস্তবায়নেই জটিলতা তাই নয়, করোনা মহামারিকালে পর্যটন খাতের লোকসান এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিগত সরকার এবং বেসরকারি পর্যটন খাত। গত কয়েক বছর ধরে টানা লোকসান দিয়ে যাচ্ছে পর্যটন করপোরেশন। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে তাদের লোকসান গুনতে হয়েছে ১০ লাখ টাকা। পরের অর্থবছরে ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ কোটি টাকা আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে লোকসান দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

ক্রমাগত লোকসানের বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো অনেক পুরোনো। সেখানে ভালো আয় হচ্ছে না। আবার নিজেদের অর্থ না থাকায় সংস্কারও করতে পারছি না। সেগুলো বেসরকারি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার পরিকল্পনায় কাজ চলছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও আবু তাহের মো. জাবের ইত্তেফাককে বলেন, করোনা মহামারিসহ নানা কারণে আমাদের কাজ শেষ করতে দেরি হয়েছে। তবে চূড়ান্ত মহাপরিকল্পনা এখন জাতীয় পর্যটন কাউন্সিলে অনুমোদন করাতে হবে। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পাঁচটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে তিনটা ইকো ট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্প। একটা টাঙ্গুয়ার হাওর, নিঝুম দ্বীপ, সুন্দরবনের শরণখোলা। আরেকটা হচ্ছে হেরিটেজ ট্যুরিজমের মধ্যে পাহাড়পুরের সোমপুর বিহারসংলগ্ন এলাকা। আরেকটা বিজনেস ট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্প নিয়ে স্টেক হোল্ডারসহ সরকারি কর্মকর্তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদসহ পর্যটন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আলোচনা করে প্রকল্পপ্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এ প্রকল্পগুলো অনুমোদন পেলে অন্তত পাঁচটি এলাকাকে আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলতে পারব। এসব উন্নয়ন কেবল সরকারি অর্থে বাস্তবায়ন হবে না, স্বল্প মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে বেসরকারি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগেই এগুতে হবে। ইতিমধ্যে আমরা বিডার সঙ্গে আলোচনা করেছি। অনেকে বিনিয়োগের আগ্রহও প্রকাশ করেছে।

পাটা বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক রহমান বললেন, কোনো কিছু মাস্টারপ্ল্যানের নীতিমালায় হচ্ছে না। আমাদের মাস্টারপ্ল্যান আরও ১০ বছর আগেই হওয়া উচিত ছিল। মাস্টারপ্ল্যান না থাকার কারণে আমরা পিছিয়ে পড়েছি।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম ইত্তেফাককে বলেন, দেশের অর্থনীতির জন্য পর্যটন একটি বড় সম্ভাবনাময় খাত। তবে এই শিল্পের বিকাশ ও মানোন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। এছাড়া বৃহত্তর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, শ্রীমঙ্গল থেকে শুরু করে ইকো ট্যুরিজম প্রয়োজন। বিশেষ করে আন্তঃসংযোগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি রিলিজিয়ন ট্যুরিজমের সম্ভাবনাকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

পর্যটনের উন্নয়নে ১৯টি মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততা আছে। কিন্তু এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দীর্ঘদিনের। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরেফ বলেন, মাস্টারপ্ল্যান হয়ে গেলে আমরা এলাকাভিত্তিক কাজগুলো গুছিয়ে করতে পারব। এই খাতে মনোযোগ দিলে সৌন্দর্য যেমন বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে এবং জিডিপিতে এর অবদানও বেড়ে যাবে।

আরও দেখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *