Mon. Sep 9th, 2024

ছাত্রদের উদ্দেশে ড. ইউনূস: স্বপ্ন পূরণের আগে দমে যেও না

অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার যে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু হয়েছে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমরা এর থেকে বেরিয়ে যেও না।’ তিনি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছাত্রদের সার্বক্ষণিক কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে রোববার ছাত্র সংগঠক এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান উপদেষ্টা একথা বলেন। সভার শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ ও আহত শিক্ষার্থীদের কথা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। এ সময় হতাহতদের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ড. ইউনূস। কাঁদতেও দেখা যায় তাকে। অধ্যাপক ইউনূস গত ১৫ বছরের অপশাসনের কথা স্মরণ করে শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘এতদিন তারা চুপচাপ শুয়ে শুয়ে স্বপ্নের মধ্যে ছিল এবং আনন্দসহকারে লুটপাট করে যাচ্ছিল। এরা কি এখন চুপচাপ বসে থাকবে। না, তারা খুব চেষ্টা করবে আবার তোমাদেরকে দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবে না। কাজেই যে কাজ শুরু করেছো, তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এর থেকে বেরিয়ে যেও না।’

দেশের সফল অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে নোবেল বিজয়ী ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত এই সুযোগ আসেনি। তবে সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। এই সুযোগ হাতছাড়া হলে বাংলাদেশের আর কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না। রাষ্ট্র আর থাকবে না। কাজেই এটা শুধু রাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর সম্মানিত রাষ্ট্র হিসাবে যেন প্রতিষ্ঠিত হয়, সেটা করতে হবে।’

তরুণরা কোনো জাদুমন্ত্রে বাংলাদেশে বিপ্লব সংঘটিত করেছে, তা দেখতে সারা দুনিয়ার মানুষ এদেশে আসবে এমন ধারণা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দুনিয়ার মানুষ দেখতে আসবে, তোমাদের কাছ থেকে শিখতে আসবে। তোমাদের কাছে জানতে চাইবে-কোন মন্ত্র দিয়ে এই বিপ্লব করেছো। এই মন্ত্র তারা শিখতে চাইবে।’ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমাদের মন্ত্র কী, সেটা হয়তো তোমরা বুঝতে পারছো না। এটা একটা বড় মন্ত্র। এই মন্ত্র ধরে রাখো। মন্ত্র যদি শিথিল হয়ে যায়, আমাদের কপালে অশেষ দুঃখ আছে। সেই দুঃখ যেন আমাদেরকে দেখতে না হয়।’

অভ্যুত্থান পরবর্তীতে তরুণরা দেশের হাল ধরেছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, তরুণরা দেশের হাল ধরেছে, তারা অনন্য এক বাংলাদেশ তৈরি করে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ চিন্তায় অনড় থাকার পরামর্শ দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, তোমাদের চিন্তা স্বচ্ছ ও সঠিক। তোমরা নিজ নিজ চিন্তায় অনড় থাক। কেউ যদি স্বপ্ন পূরণের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেয়, সেটা গ্রহণ করো না। তিনি বলেন, স্বপ্ন বাস্তবায়ন থেকে যদি আমরা দূরে সরে যাই, দেশবাসী তাহলে আমাদেরকে সতর্ক করে দেবে। আমাদের কারোর কোনো ইচ্ছা নেই এই স্বপ্নের বাইরে যাওয়ার। আমাদের সার্বক্ষণিক কাজ হলো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। একযোগে এই কাজ করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দেখছি আর ভাবছি কী একটা স্বপ্ন আমাদের সবার সামনে, জাতির সামনে তোমরা নিয়ে এসেছো। যারা শহিদ হয়েছে, তাদের স্মরণ করি। যারা শহিদ হয়েছে, তারা চলে গেছে। তোমাদের দিকে তাকাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম তোমরাও শহিদ হয়ে যেতে পারতে। শহিদরা আজ আমাদের সঙ্গে বসতে পারত, সেই সুযোগ তাদের দেওয়া হয়নি।

আহতদের হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘যখন হাসপাতালে শিক্ষার্থীদের দেখার জন্য যাই, তাদের দিকে তাকাতে কষ্ট হয়। একটা ছেলে, একটা মেয়ে এইরকমভাবে কীভাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই দিকে পা চলে গেছে, ওই দিকে মাথা।’

আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ড. ইউনূস বলেন, ‘একজন তাজা তরুণ রংপুরে আমাকে বলল, ফুটফুটে একটা ছেলে, স্যার আমি সারাজীবন ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলাম। ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলাম। এখন দেখেন আমার পা কেটে ফেলেছে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে স্যার ক্রিকেট খেলব কী করে? ক্রিকেট তার মাথা থেকে যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘আহতদের যতবার দেখি ততবার মনে প্রশ্ন জাগে, কী বাংলাদেশ আমরা বানিয়েছি যে, এতগুলো তাজা প্রাণ, তাদেরকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো। আমরা যারা আজকে এখানে বসে কথা বলছি, তাদের একমাত্র দায়িত্ব তাদের এই ত্যাগ, এই জীবনের মূল্যের স্বপ্ন পূরণ করা।’

নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে আহতদের দেখতে যাওয়ার কথা স্মরণ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘গতকাল একটা হাসপাতালে গেলাম আবার সেই দৃশ্য কচিকচি প্রাণ, মাথার খুলি উড়ে গেছে। মাথার অর্ধেক নেই, গুলি মাথার ভেতর রয়ে গেছে। রংপুরের হাসপাতালের দৃশ্য, এক্স-রে’তে দেখা যাচ্ছে ওখানে দাগ ছোট ছোট ফুটো করা, আমি বুঝতে পারলাম না আমাকে কী দেখাচ্ছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম। এগুলো কী? এতগুলো গুলি তার শরীরে রয়ে গেছে, সে বেঁচে আছে রাবার বুলেট, যতবার দেখি যতবার শুনি আবার নতুন করে প্রতিজ্ঞা করতে হয়, যে স্বপ্নের জন্য তারা প্রাণ দিয়েছে, সেই স্বপ্নকে আমরা বাস্তবায়ন করব। এটার থেকে আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।’

তিনি বলেন, আমাদের যোগ্যতা না থাকতে পারে, ক্ষমতা না থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা রইল, আমরা স্বপ্ন পূরণ করব। হাসপাতালের দৃশ্য এবং আন্দোলনের প্রতিদিনের ঘটনা মানুষকে জানাতে হবে, বোঝাতে হবে এর পেছনে কী ছিল।

সভায় উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল; বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার; তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ন্যায্যতা ও সততার ভিত্তিতে-মাহফুজ আলম : ভারতের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক দরকার। কিন্তু সেটা হতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে, সততার ভিত্তিতে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বরাত দিয়ে তার বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলম এসব কথা বলেন। রোববার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এবং অপূর্ব জাহাঙ্গীর।

মাহফুজ আলম বলেন, সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করবেন বলে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন। এছাড়া শহিদদের জন্য একটি ফাউন্ডেশনের কাজ চলমান রয়েছে, তার মাধ্যমে শহিদ পরিবারগুলোর পুনর্বাসন এবং তাদের রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও সম্মান নিশ্চিত করা হবে। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি থাকবে কি না, থাকলে কী ফরম্যাটে থাকবে সেগুলো নিয়ে সব জায়গায় আলোচনা হচ্ছে। আমরা চাই আরও আলোচনা হোক। তাহলে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। মব জাস্টিসের বিষয়ে তিনি বলেন, সারা দেশে মাজার ও মন্দিরে হামলা কিংবা ব্যক্তি আক্রোশের কারণে হামলার বিষয়ে আইন যেভাবে বলে সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা ফ্যাসিস্টের দালালি বা দোসর হিসাবে কাজ করেছেন, জনগণ তাদের বিচার করবে না, বরং আইন তাদের বিচার করবে। জনগণ শুধু এইটুকু খেয়াল রাখবে যে, এ বিষয়ে যেন কোনো কম্প্রোমাইজ না হয় এবং যারা শহিদ বা আহত হয়েছেন তাদের সঙ্গে যেন বেইমানি না হয়। এ বিষয়ে সরকার কঠোর হচ্ছে। মাহফুজ আলম বলেন, আজকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক ছিল মূলত এ সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস উপলক্ষ্যে তাদের মতামত শোনার জন্য। সেখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রশ্ন করেছেন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারসহ বিভিন্ন প্রস্তাবনা জানিয়েছেন। ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী অংশ নেন। এখানে শুধু সমন্বয়কই শুধু নয়, যারা আন্দোলনে বিভিন্ন স্থানে নেতৃত্বে ছিলেন তারা ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের বলেছেন, তারা যেন অন্তত মাসে একবার তাদের মতামত জানান।

আরও দেখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *