Tue. Aug 27th, 2024

শঙ্কা নেই, জ্বালানি তেল সরবরাহ অব্যাহত থাকবে

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া ও বিরাজমান ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি তেল আমদানি খাতে বড় অংকের অর্থ বকেয়া পড়েছে। এতে জ্বালানি তেল আমদানির ধারাবাহিকতা থমকে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা হচ্ছে না। বাংলাদেশে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বকেয়া পরিশোধে তাগাদা দিলেও তেল সরবরাহ অব্যাহত রাখছে। গেল সপ্তাহে বিদেশি একটি প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠক শেষে তেল আমদানি অব্যাহত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

দেশের জ্বালানি তেলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনা ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা।

বিপিসি সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে প্রায় ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এই তেলের অন্তত ৯২ শতাংশ আমদানি করা হয়। বিপিসি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়িক কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তেল আমদানি করে। আমদানিকৃত জ্বালানি তেল তিনটি বিপণনকারী কোম্পানি পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানির মাধ্যমে বাজারজাত করে।

দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১৫ থেকে ১৬ জাহাজে বোঝাই করে ৪০০ থেকে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। এর মধ্যে আমদানিকৃত ক্রুড ইস্টার্ন রিফাইনারির মাধ্যমে পরিশোধন করা হয়। আমদানিকৃত পরিশোধিত তেল তিনটি বিপণনকারী কোম্পানির মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়।

চলতি ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরে ৭৩ লাখ ১০ হাজার টন জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এই হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে ১৫ কিংবা ১৬টি জাহাজ জ্বালানি তেল নিয়ে আসে। এ বছর মোট ৫৯ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন পরিশোধিত এবং ১৪ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করার কথা রয়েছে। পরিশোধিত তেলের মধ্যে ৩০ লাখ ৮০ মেট্রিক টন আমদানি করা হচ্ছে জি–টু–জি চুক্তির মাধ্যমে। ২৮ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে আমদানি করা হচ্ছে। পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মধ্যে সিংহভাগ ডিজেল। এছাড়া জেট এ–১, ফার্নেস অয়েল এবং মেরিন ফুয়েলসহ কয়েক ধরনের জ্বালানি তেল রয়েছে।

বিপিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, আরব আমিরাতের অ্যামিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (ইএনওসি), চায়নার পেট্রোচায়না ইন্টারন্যাশনাল (সিঙ্গাপুর) প্রাইভেট লিমিটেড ও ইউনিপেক সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড, ভারতের নুমালিগার রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) ও ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেড (আইওসিএল), মালয়েশিয়ার পেটকো ট্রেডিং লাবুয়ান কোম্পানি লিমিটেড (পিটিএলসিএল), সিঙ্গাপুরের ভিটল এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেড, ইন্দোনেশিয়ার পিটি ভূমি ছিয়াক পোছাকো (বিএসপি), থাইল্যান্ডের পিটিটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে জি–টু–জির আওতায় পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি হয়।

অপরদিকে ক্রুড অয়েল অ্যারাবিয়ান লাইট ক্রুড অয়েল (এএলসি), সৌদি অ্যারাবিয়ান অয়েল কোম্পানি (সৌদি আরামকো) এবং মারবান ক্রুড অয়েল আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (এডনক) থেকে আমদানি করা হয়।

এসব কোম্পানির মাধ্যমে বিপিসি দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি তেল আমদানি করছে। কোম্পানিগুলোর বড় ক্রেতা হচ্ছে বিপিসি। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করলেও আগে কখনো বিপিসির কাছে এসব বিদেশি কোম্পানির টাকা আটকা পড়েনি। বছর দুয়েক ধরে প্রায় প্রতি জাহাজেই টাকা আটকা পড়ার ঘটনা ঘটছে।

ডলার সংকটের কারণে বিপিসি বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনা ঠিকভাবে পরিশোধ করতে পারছে না। একটি জাহাজে গড়ে ২৫ মিলিয়ন ডলারের তেল থাকে। তেলের মূল্য হিসেবে বিপিসিকে তেল জাহাজিকরণের ৩০ দিনের মধ্যে সকল পাওনা ডলারে পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু গত বছর দুয়েক ধরে তা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো সময় ৪০/৫০ দিন পরেও পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে। আবার এক জাহাজ তেলের দাম এক সাথে পরিশোধ না করে ভেঙে ভেঙে করা হচ্ছে। ফলে একেকটি জাহাজের বিপরীতে ৫/৭ মিলিয়ন ডলার বকেয়া থেকে যাচ্ছে। এভাবে প্রতি জাহাজে টাকা জমতে জমতে বকেয়া থাকা ডলারের পরিমাণ ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

বিপিসির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বিপিসি প্রতি মাসে যে পরিমান জ্বালানি তেল আমদানি করে, তার থেকে বেশি টাকায় ওই তেল বিক্রি করে। প্রতি মাসেই বিপিসির মুনাফা হয়। এরপরও ডলার সংকটের কারণে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে পুরো অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রায় দুই বছর ধরে এসব কোম্পানির কাছে বিপিসির দেনা ২০০ মিলিয়ন ডলারের কাছে ছিল। কিন্তু গত মাস কয়েকের মধ্যে তা ৫০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। এই অবস্থায় বিদেশি কোম্পানিগুলো আটকে পড়া বকেয়ার জন্য দফায় দফায় তাগাদা দেয়।

তবে গত সপ্তাহে সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর একাধিক টিমের সাথে বিপিসির শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। বৈঠকে দ্রুত বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে কোম্পানিগুলোকে আশ্বস্ত করা হয়। এতে করে জ্বালানি তেল সরবরাহ নেটওয়ার্ক বা ইমপোর্ট চেইন ভেঙে যাওয়ার যে শঙ্কার কথা বলা হচ্ছিল তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে বলে জানান বিপিসির ওই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। তবে বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনার পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। এক্ষেত্রে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ২ লাখ ৬৫ হাজার টন ডিজেল, ৬৫ হাজার টন জেট ফুয়েল, ২৫ হাজার টন অকটেন এবং ৭৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল আমদানির কথা রয়েছে।

বিপিসির ওই কর্মকর্তা জানান, দেশে জ্বালানি তেলের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। জ্বালানি সংকটের কারণ নেই। গতকাল প্রায় ৫ লাখ টন ডিজেল, ৬০ হাজার টন জেট ফুয়েল, ৪০ হাজার টন অকটেন, আড়াই লাখ টন পেট্রোল এবং ৬০ হাজার টন ফার্নেস অয়েলের মজুদ ছিল। যা দিয়ে এক মাসের বেশি সময়ের চাহিদা মেটানো সম্ভব। পাইপলাইনে বেশ কয়েকটি জাহাজ থাকার কথাও জানান তিনি।

 

আরও দেখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *