বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে অর্থনৈতিক অর্জনকে স্ফীত করে দেখানোর যে অভিযোগ রয়েছে, তা যাচাই করে দেখা হবে। দুর্নীতি দমনের অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আমলের অব্যবস্থাপনার তথ্য সংবলিত শ্বেতপত্র তৈরি করতে বলেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ জন্য তাঁকে সময় দেওয়া হয়েছে ৯০ দিন। তিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন দেবেন।
গতকাল সোমবার ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। ঢাকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গত শনিবার দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, তথ্য সংগ্রহ নিয়ে তারা গুরুতর সমস্যায় পড়েছেন। আসল তথ্য চেপে রাখা হয়েছে। তিনি এটাকে ‘তথ্যের নৈরাজ্য’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, হাসিনা প্রশাসন সম্ভবত রপ্তানি, মুদ্রাস্ফীতি ও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ভুল তথ্য প্রকাশ করত, যা দেশের অর্থনীতিকে ‘নজিরবিহীনভাবে দুর্বল’ করেছে।
শেখ হাসিনা সরকার গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ দশমিক ৩৬ ট্রিলিয়ন টাকা দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা রেখে গেছে। এ ঋণের অর্থ তিন অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের সমান। দেবপ্রিয় বাংলাদেশের জন্য তিনটি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো– সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতি। তিনি বলেন, কয়েক বছরে স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়েছে এবং শেখ হাসিনা এর জন্য ইউক্রেনের যুদ্ধকে দায়ী করেছেন। তবে এটা যুক্তিযুক্ত নয়।
দেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, যা বিশ্বে সর্বনিম্ন। এ অনুপাত ২০২৫ সালের জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে ৮ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সবচেয়ে বড় বৈপরীত্যের জায়গা হলো– আপনার ৫ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি রয়েছে; আবার আপনি কর সংগ্রহ করেন না। এর অর্থ দাঁড়ায় যে, হয় আপনার প্রবৃদ্ধি কাল্পনিক, নয়তো যারা প্রবৃদ্ধি থেকে উৎপন্ন আয়ে উপকৃত হয়েছেন, তারা করের আওতায় আসেননি। সম্ভবত এর একটি বড় অংশ দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক কাজ হলো বিদ্যুতের মতো জরুরি পরিষেবার জন্য অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত সপ্তাহে বলেছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে অতিরিক্ত ৩ বিলিয়ন ডলার জরুরি সহায়তার জন্য আলোচনা চালাচ্ছেন তারা। অন্য বহুপক্ষীয় ঋণদাতাদের কাছ থেকে তহবিল চাইছেন। রপ্তানিতে ব্যাঘাত ঘটায় তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। বর্তমান সংকটের আগে থেকেই এ রিজার্ভ কম ছিল। গভর্নর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য আন্তঃব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনছে।
১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশ উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার ক্ষেত্রে কঠিন লড়াই করছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো– ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নীত হওয়ার জন্য আদৌ প্রস্তুত কিনা। সরকার পরিবর্তন ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার জেরে জাতিসংঘ সম্প্রতি সলোমন দ্বীপপুঞ্জের এলডিসি (স্বল্পোন্নত) ক্যাটেগরির বাইরে যাওয়ার বিষয়টি স্থগিত করে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশ যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তা সামনের ধাপে উন্নীত হওয়ার সমস্যা নয়, বরং উন্নয়নের সমস্যা। অস্থিরতা ও নেতৃত্বের পরিবর্তন সত্ত্বেও দেশ সঠিক পথে রয়েছে। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশের অভ্যুত্থান যে কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকারের ‘প্লেবুকে’ অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারে।